স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি - প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি - প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান |
স্বাধীনতা
যুদ্ধের স্মৃতি
লেখক
: প্রেসিডেন্ট জিয়াউর
রহমান
প্রকাশ
সাল: ১৯৮০, পত্রিকা: দৈনিক দেশ, সংখ্যা: বর্যপূর্তি সংখ্যা।
সবাই
আমরা যুদ্ধ করেছি, সৈনিক,
জনগণ সবাই। আর
সেই ঝুঁকির কথা? জাতির
চরম সংকটের মুহুর্তে কাউকে
না কাউকে সামনে এগিয়ে
আসতে হবে। নিতে
হয় দায়িত্ব। আমি
কেবল সে দায়িত্ব পালন
করেছি। নেতারা
যখন উধাও হয়ে গেল—
সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত কেউ
যখন থাকল না, তখন
জাতির পক্ষ থেকে সব
থেকে বড় সিদ্ধান্ত আমাকে
ঘোষণা করতে হল।
কারণ জাতিকে তো আর
অসহায় নিরস্ত্র অবস্থায় একটা সর্বাত্বক ধ্বংসের
মুখে ফেলে রাখা যায়
না। এবং
আমি জানতাম যুদ্ধের জন্য
জাতি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।
শুধু বাকি ছিল সেই
যুদ্ধের জন্য একটি সঠিক
সময় বেছে নেয়া।
ছাব্বিশে মার্চ রাতের প্রথম
প্রহরে সেই সময়টি এলো। যার
জন্য গোটা মাস আমরা
রুদ্ধশ্বাস হয়ে প্রতিজ্ঞা করছিলাম। এবং
সময় আসোবার সঙ্গে সঙ্গে
আমি সে ঘোষণা অষ্টম
ব্যাটেলিয়ানের আমার যোদ্ধাদের জানিয়ে
দিলাম। মুহুর্তের
মধ্যে তাঁরা প্রস্থত হল
এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পরদিন
চট্টগ্রাম রেডিও থেকে জাতিকে
আমি সেই সিদ্ধান্তের কথা
জানালাম। জাতি
স্বমস্বরে সাড়া দিল সেই
ডাকে। বেতার
তরঙ্গের সেই সন্ধ্যার ঘোষণা
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রেডিও
তে ধরা পড়ল।
আর বিশ্ববাসী সেই প্রথম শুনলঃ
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম
রাষ্ট্রের ঘোষণা নিয়ে যুদ্ধে
নেমেছে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর
সঙ্গে। বেতার
থেকে বেতারে সেই ঘোষণা
প্রতিধ্বনিত হল ২৭শে মার্চ
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে
ইথারে ঘোষণাটি উচ্চারিত হবার পড় মহুর্তেই
বিশ্ব মানচিত্রে অংকিত হয়ে গেলো
“স্বাধীন বাংলাদেশ” কথাটি। সে
ছিল সত্যি এক অলৌকিক
ব্যাপার। মাত্র
কয়েক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন একটি বেতারের ঘোষণা
কেমন করে বিশ্বময় ছড়িয়ে
পড়লো তা ভাবতে আজও
আমার অবাক লাগে।
নিশ্চয় এর মধ্যে ছিল
বিশ্বস্রষ্ঠার কল্যাণময় সংকেত। পয়লা
মার্চ থেকেই বাংলাদেশ হামলার
পাকাপাকি প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল
পাকিস্তানী শাসক চক্র।
বিমানে এবং জাহাজে করে
প্রচুর সমরাস্ত্র তাঁরা পাঠালো, প্রতিদিন
আসতে লাগল নতুন নতুন
সেনাদল।
চট্টগ্রামের
ষোল শহর ছিল ইস্ট
বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সদল দপ্তর। নতুন
একটি ব্যাটেলিয়ান গড়ে তুলবার কাজ
চলছিল কিছু কাল আগে
থেকে। এটি
অষ্টম ব্যাটেলিয়ান। নতুন
এই ব্যাটালিয়ানের দু’শ জনের
একটি দলকে আগেই পাঠিয়ে
দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের খারিয়ান
অঞ্চলে। এদিকে
বেশির ভাগ জোয়ানই ছিল
ছুটিতে। মাত্র
দু’শ কুড়ি জন
ছিল ডিউটিতে। অস্ত্রও
ছিল সামান্য। অস্ত্র
বলতে ছিল ৩০৩ মডেলের
কিছু রাইফেল, চারটি এল-এম-জি, দু’টি
মর্টার, সার্ভিস কেবল দু’টি
আর সামান্য গোলাবারুদ। কোন
এন্টিট্যাঙ্ক বা ভারি মেশিনগান
ছিল না।
চট্টগ্রামে
১লা মার্চ থেকে ২০তম
বেলুচ রেজিমেন্টের রহস্যজনক গতিবিধি থেকে আমরা সুস্পষ্ট
আঁচ করতে পারছিলাম- কি
ঘটতে যাচ্ছে। রাতের
অন্ধকারে তারা শহরের মহল্লায়
গিয়ে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠত।
আমাদের জোয়ানকে গোপনে মোতায়েন করলাম
তাদের দিকে নজর রাখার
জন্য। আমি
তখন ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার। পাকিস্তানী
অফিসার লেঃ কর্ণেল জানজুয়া
ছিলেন ব্যাটালিয়ান প্রধান। তিনি
প্রথম থেকেই আমাকে সন্দেহের
চোখে দেখছিলেন। আমার
বাসার কাছে ঘোরাঘুরি করছিল
তার নিয়োজিত গোয়েন্দারা। এদিকে
ক্রমেই ওদের পরিকল্পনার নীলনকশা
স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল
আমাদের কাছে। দেশের
নানা জায়গায় ওদের নৃশংস
বর্বরতা ও লুটতরাজের খবরও
পৌঁছাতে লাগল। খবর
পাওয়া গেল ব্যাটালিয়নদের নিরস্ত্র
করা হবে। ব্যাটালিয়ানের
তরুণ অফিসার দল এবং
প্রধান জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের
মধ্যে তখন এক চরম
উত্তেজনা। তারা
আমাদের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত
জানার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ব্যাটালিয়নের
কোয়াটার মাস্টার ছিলেন ওয়ালী আহমদ। শমসের
মবীন ও খালিকুজ্জামান তখন
ক্যাপ্টেন। তারা
ওয়ালী আহমদ (ওলী আহমদ)
ও মেজর শওকত এর
মাধ্যমে আমাকে বলে পাঠালেন,
আমি যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ
ঘোষণা করি তারা সঙ্গে
সঙ্গে অস্ত্র হাতে তুলে
নেবেন। এবং
দেশের স্বাধীনতার জন্য সবাই জীবন
উৎসর্গ করবেন। জেসিও
এবং এনসিও গণও আমার
বাসায় আসতে লাগলেন।
তারা বললেন- একটা চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
তা না হলে বাংলাদেশের
জনগণকে চিরকালের জন্য ক্রীতদাসে পরিণত
করা হবে। বোধকরি
তারিখটা ছিল ৪ঠা মার্চ। কোয়ার্টার
মাস্টার কর্নেল ওলীকে ডেকে
পাঠালাম। ষোল
শহর মার্কেটের ছাদের উপর আমরা
বসলাম। এটি
আমাদের প্রথম বৈঠক।
আমি আগেই ঠিক করে
রেখেছিলাম। কী
সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে। সোজাসুজি
তাঁকে বল্লামঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দ্রুত ঘনিয়ে
আসছে। আমাদের
এখন থেকে সর্বক্ষণ প্রস্তুতি
নিয়ে থাকতে হবে।
পরবর্তি
বৈঠকে ক্যাপ্টেন ওলী আহমদ মেজর
আমিন চৌধুরী ও লে.
ক. এম আর চৈৗধুরীও
যোগ দিলেন। প্রথম
বৈঠকে একটি একশান প্ল্যান
এর রূপরেখা তৈরি করা হল। তার
ভিত্তিতে রোজ একই জায়গায়
আমরা বৈঠকে মিলিত হচ্ছিলাম। নিঃশব্দে
একইভাবে চলল আমাদের চূড়ান্ত
প্রস্তুতির কাজ।
১৩ই
মার্চ নেতাদের সাথে ইয়াহিয়া খানের
গোলটেবিল বৈঠক শুরু হল। এর
মধ্যেই পাকিস্তানী জেনারেলরা একের পড় এক
বিমানে করে আসতে লাগল। সব
গ্যারিসন অফিসে শুরু হল
তাদের আনাগোনা। এ
ছিল সর্বাত্মক হামলার এক ভীতিকর
পূর্বাভাস। নৌবাহিনীর
শক্তি বাড়ানো হল চট্টগ্রামে। রণতরী,
পিএনএস “বাবর” এর সঙ্গে
এলো অনেকগুলো ডেস্টচ্ছার, ফ্রিগেট, আর গানশিপ।
২১শে
মার্চ জেনারেল হামিদ এলেন চট্টগ্রাম
ক্যান্টনমেন্টে। এই
জেনারেলই পাকিস্তানের সামরিক হামলার পরিকল্পনা
তৈরি করেছিলেন। চট্টগ্রামে
তখন জনগণের তীব্র প্রতিরোধ
গড়ে উঠেছিল। রাস্তায়
রাস্তায় ছিল ব্যারিকেড।
“সোয়াত” জাহাজের অস্ত্র খালাস করার
জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা ২৪শে মার্চ ব্যারিকেড
সরিয়ে কোনমতে চট্টগ্রাম বন্দরে
পৌঁছল। পথে
জনগণ তাদের বাধা দিয়েছিল। খন্ডযুদ্ধে
প্রাণ হারালেন বহুলোক। এটি
ছিল চরম মূহূর্তের সংকেত। আমরা
প্রস্তুত হয়ে থাকলাম সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।
দ্রুত
ঘনীয়ে এলো ছাব্বিশের সেই
রাত।
২৫শে মার্চ রাত তখন ১১টা। চট্টগ্রাম
বন্দরে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করার
জন্য ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার আমার কাছে
নির্দেশ পাঠালেন। নৌবাহিনীর
একটি ট্রাক পাঠানো হলো
আমাকে এসকর্ট করে নিয়ে
যাওয়ার জন্য। দু’জন পাকিস্তানী অফিসারকে
আমার সাথে দেওয়া হল। ট্রাকের
চালক ছিলেন একজন পাঞ্জাবী। আমার
সাথে ছিল আমার ব্যাটালিয়ানের
মাত্র তিনজন জোয়ান।
এতো রাতে কেন তারা
আমাকে বন্দরে রিপোর্ট করতে
পাঠাচ্ছে? একটা সংশয় আমার
মনে দানা বেধে উঠছিল। আসলে
তারা আগেই টের পেয়েছিল। আমি
চরম একটা পদক্ষেপ নিতে
যাচ্ছি। সুতরাং
তারা চাইছিল আমাকে শেষ
করে ফেলতে। তাই
সে রাতেই তারা ষড়যন্ত্র
এটে রেখেছিল।
আগ্রাবাদের
একটি বড় ব্যারিকেডের সামনে
ট্রাক থেমে গেলো।
আমি নেমে পায়চারি করছিলাম
রাস্তায়। ভাবছিলাম
কখন সবাইকে সিদ্ধান্তের কথা
জানিয়ে দেব? ঠিক সে
সময়ে মেজর খালিকুজ্জামান সেখানে
আমার সঙ্গে দেখা করলেন। অনুচ্চস্বরে
বললেন, ওরা ক্যান্টনমেন্টে হামলা
শুরু করেছে। শহরেও
অভিযান চালিয়েছে। হতাহত
হয়েছে শহরের বহু নিরীহ
মানুষ।
বুঝতে
পারলাম যে সময়ের জন্য
অপেক্ষা করছিলাম সে সময় এসে
গেছে। সঙ্গে
সঙ্গে বলে উঠলাম “উই
রিভোল্ট” নির্দেশ দিলাম। ষোল
শহরে ছুটে যাও।
পাকিস্তানী অফিসারদের আটক করো।
যুদ্ধের জন্য তৈরি করে
রাখো ব্যাটালিয়ানদের সবাইকে। ট্রাকে
উঠে পাঞ্জাবী ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলাম ট্রাক ফিরিয়ে
নিয়ে চলো ব্যাটালিয়ান হেড
কোয়াটারের দিকে। সৌভাগ্য
বলতে হবে। সে
নিঃশব্দে আমার নির্দেশ পালন
করলো।
ষোল
শহরে এসে দ্রুত নেমে
পড়লাম ট্রাক থেকে।
নৌবাহিনীর আটজন এসকর্ট ছিল
আমার সঙ্গে। মুহুর্তে
একটি রাইফেল কেড়ে নিলাম
তাদের একজন কাছ থেকে। সঙ্গে
সঙ্গে পাকিস্তানী নেভাল অফিসারটির দিকে
রাইফেল তাক করে বললাম,
“হ্যান্ডস আপ”। তোমাকে
গ্রেফতার করা হল।
ঘটনার আকস্মিকতায় সে হচকে গিয়ে
আত্মসমর্থন করলো। অন্যদের
দিকে রাইফেল উঁচিয়ে বলতেই
তারা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে
অস্ত্র নামিয়ে রাখল।
ব্যাটালিয়ান কমান্ডারকে ঘুম থেকে তুলে
এনে পাকড়াও করা হল। ইস্ট
বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে এলাম। লে.
কর্ণেল চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন
রফিকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের
চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সিভিল
টেলিফোন সার্ভিসের একজন অপেরেটরকে টেলিফোনে
পেলাম। তাঁকে
বললামঃ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের
অষ্টম ব্যাটালিয়ান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা করেছে।
এ সংবাদটি যেন চট্টগ্রামের ডিসি,
কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি আর রাজনৈতিক
নেতাদের জানিয়ে দেয়।
কারণ টেলিফোনে আমি তাদের কাউকে
পাচ্ছিলাম না। টেলিফোন
অপারেটর দারুণ আনন্দ প্রকাশ
করল আমার কথায়।
এবং ঐ গভীর রাতেই
সবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা
করল সে।
২৬শে
মার্চ ১৯৭১
সেই
মুহূর্ত ছিল জাতির ইতিহাসে
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ব্যাটালিয়ানের
সব অফিসার আর জোয়ানদের
এক জায়গায় একত্র করে
সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলাম।
বললামঃ আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে
নেমেছি। “উই
রিভোল্ট ফর আওয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট”। তারা
এই ঘোষণার জন্যই উন্মুখ
হয়ে অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে
সঙ্গে সবাই উল্লাস ধ্বনি
করে সাড়া দিল।
পড় মুহুর্তেই স্বসস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে
গেল। রাত
তখন ২ টা ১৫
মিনিট। ২৬শে
মার্চ ১৯৭১। জাতির
জন্য অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তটি।
স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ এখন
শুরু হল।
রাত
৪টায় রেল লাইন ধরে
পটিয়ার পাহাড়ের দিকে আমরা যাত্রা
করলাম। পথে
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর
একশজন আমাদের সাথে যোগ
দিল। দুপুরে
পটিয়ার পাহাড়ে পৌঁছে গেলাম। জাতির
সেই প্রথম স্বাধীনতা যোদ্ধাদের
পথে পথে প্রাণঢালা অভিনন্দন
জানালো জনগণ। তারা
খাবার নিয়ে আসল ক্ষুধার্ত
সৈনিকদের জন্য। স্বাধীনতা
যুদ্ধের প্রথম ঘাটি হল
পটিয়ার পাহাড়। সেই
প্রথম পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমর। বহু
দেশপ্রেমিক প্রাণ দিলেন দেশের
মাটিকে মুক্ত করার জন্য। পাকিস্তানী
শিবিরে তখন আতংক।
তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হল। আমরা
এখন সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত।
কালুরঘাটে
চটগ্রাম রেডিওর কেন্দ্র।
সেখানে একদল ছাত্র ও
বেতার শিল্পী দেশাত্ববোধক সঙ্গীত
পরিবেশন করছিল। দিনটি
ছিল ২৬শে মার্চ।
শহরের চারদিকে তখন বিক্ষিপ্ত লড়াই
চলছিল। সন্ধ্যা
সাড়ে ছয়টায় রেডিও স্টেশনে
এলাম। এক
টুকরো কাগজ খুঁজছিলাম।
হাতের কাছে একটা খাতা
পাওয়া গেল। তার
একটি পৃষ্ঠায় দ্রুত হাতে স্বাধীনতা
যুদ্ধের প্রথম ঘোষণার কথা
লিখলাম। স্বাধীন
সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার নিয়েছি সে কথাও
লেখা হল সেই ঘোষণায়। বললামঃ
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। প্রিয়
দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও লিবারেশন আর্মির প্রধান
হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছি।আপনারা যে যা পারেন সামর্থ্য অনুযায়ী
অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে
দেশ ছাড়া করতে হবে।ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।” জনগণ এবং পুলিশ,
আনসার, ইপিআর, ছাত্র যুবক
সবাইকে জাতির প্রতিরক্ষার দায়িত্ব
পালনের জন্য আহ্বান জানালাম। কিছুক্ষণের
মধ্যেই সেই ঘোষণা বেতারে
প্রচার করলাম। ১৫
মিনিট পর পর ঘোষণাটি
প্রচার করা হলো কালুরঘাট
রেডিও স্টেশন থেকে।
পরে রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধে দ্বিতীয় ঘোষণাটি লিখে বেতারে প্রচার করলাম ২৭শে
মার্চ । যাহোক
বিদ্যুতের মত সারা বাংলাদেশে
ছড়িয়ে পড়লো স্বাধীনতার ঘোষনাটি। আর দলে দলে
তরুণরা এসে যোগ দিতে
লাগলো স্বাধীনতা যুদ্ধে। প্রচার
করা হল ।
এপ্রিলের
প্রথম থেকে শুরু হয়ে
গেল সারাদেশ জুড়ে ব্যাপক যুদ্ধ। জনগণ
স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এগিয়ে এলো। অস্ত্রের
নিদারুণ অভাব। প্রশিক্ষণ
দেওয়া গেরিলারা হানাদারদের কাছ থেকে অস্ত্র
কেড়ে আনতে লাগল।
সে অস্ত্র দিয়ে চলছিল
যুদ্ধ। এপ্রিলেই
স্বাধীনতা যুদ্ধের হেড কোয়াটার সরিয়ে
নেওয়া হল রামগড়ে।
এরপর
বিজয়ের পড় বিজয়।
সেপ্টেম্বরের মধ্যেই উত্তর-পূর্ব
সেক্টরের গোটা রৌমারী থানা,
চিলমারী, উলিপুর ও দেওয়ানগঞ্জ
হানাদার মুক্ত হল।
২৮শে আগস্ট এই অঞ্চলে
প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু হল।
চালু হল অফিস-আদালত
ও কোর্ট-কাছারি।
তার আগে ৬ই সেপ্টেম্বর
পৌনে এক লাখ টাকার
ট্যাক্স জমা হলো স্বাধীন
বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে। বেসামরিক
শাসন চালু হবার দিন
রৌমারিতে বিশাল জনসমাবেশ হল। বলেছিলামঃ
এখানে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে আজ
রচিত হল এক যুগান্তকারী
অধ্যায়। মুক্তাঙ্গনের
এই অভিযাত্রা থেকে অচিরেই গোটা
বাংলাদেশের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি
ঘটতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের
জনগণের অনিরুদ্ধ জাতীয় চেতনাই স্বাধীনতা
যুদ্ধের চালিকা শক্তি।
এর প্রচণ্ড স্রোতের মুখে খরকুটার মত
ভেসে যাবে দখলদাররা।
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে
বৈদেশিক আধিপত্তের সব কুটিল ষড়যন্ত্র।
***১৯৮০
সালে দৈনিক দেশের বর্যপূর্তি সংখ্যায় প্রকাশিত***
সংগ্রাহক
: ডঃ শওকত আলী
অধ্যাপক,
লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
সাবেক
সহকারী সম্পাদক, দৈনিক দেশ, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
Comments