হার না মানা বেগম জিয়া
হার না মানা বেগম জিয়া |
বিবাহ ও সাংসারিক জীবন
লেখক : জয় সিদ্দিকী
#justiceforbegumzia #freebegumzia #freedemocracybd
১৯৬০ সালে ক্যাপ্টেন জিয়ার সঙ্গে বিয়ের মাধ্যমেই মূলত বেগম খালেদা জিয়ার ভবিষ্যৎ সংগ্রামী জীবনের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। স্বামী ছিলেন বীর সিপাহসালার। নানা সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে সবসময় ঝুঁকি (কখনো কখনো মৃত্যুর ঝুঁকিও) জড়িয়ে থাকে। স্বামী যেসব বিশাল মাপের ঝুঁকি নিতেন, তার প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়ত স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ওপরও। বীরবধূ হওয়ার বিড়ম্বনা সারাটি জীবনই সইতে হয়েছে তাকে, বলতে গেলে বিয়ের পর থেকেই। আর দশজনের মতো নিস্তরঙ্গ জীবন বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে হয়ত ছিল না। ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরা একটুখানি মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে তার চরিত্রে একধরনের হার-না-মানা সংগ্রামী বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ©জয় সিদ্দিকী ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে গেল। কোলে তখন তার ছয় মাস বয়সী প্রথম পুত্র সন্তান। যুদ্ধযাত্রা করলেন সিপাহসালার স্বামী। লাহোরের কাছে খেমকারান সেক্টরে স্বামী যখন বীর বিক্রমে লড়ছেন, বেগম খালেদা জিয়া তখন উদ্বেগে আকুল হয়ে বিনিদ্র সব রজনী পার করছেন। বছর পাঁচেক সংসার না করতেই আবার হাজির হল ১৯৭১ সাল। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে তখন। উত্তাল মার্চ মাসে স্বামী মেজর জিয়ার কর্মস্থল হল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নির্বিচার গণহত্যা চালাল, তখন মেজর জিয়া নিজ রেজিমেন্টসহ সেই রাতেই বিদ্রোহ করলেন। বললেন— ‘উই রিভোল্ট...।’ অর্থাত্ ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম...।’©জয় সিদ্দিকী পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারকে বন্দী করে নিজ রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তে যুদ্ধযাত্রা করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্বামী তার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেন না। বেগম খালেদা জিয়া তখন অবুঝ দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় নিরাপদ আশ্রয় পাবেন, সেই চিন্তায় দিশেহারা। প্রথমে ষোলশহরের বাসা ছেড়ে আত্মগোপন করলেন চট্টগ্রামেই চাচা দেলোয়ার হোসেনের বাসায়। পরদিন ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হল—‘আমি মেজর জিয়া বলছি...। ...আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি...।’ সংশোধিত আকারে এই স্বাধীনতার ঘোষণা মেজর জিয়ার কণ্ঠে পুনরায় উচ্চারিত হল ২৭ মার্চ তারিখেও। ইথারে স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দুই রকম। প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুবই ইতিবাচক। সারাদেশের পলায়নপর ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘুরে দাঁড়াল এই ঘোষণা শুনে। পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই কর্মরত একজন বাঙালি মেজর রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। তা শুনে নিরস্ত্র দিশেহারা বাঙালি জাতির মনে সাহসের সঞ্চার হল। আন্তর্জাতিকভাবেও মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হল।©জয় সিদ্দিকী দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি ছিল খুবই নেতিবাচক, বিশেষ করে অরক্ষিত বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই শিশুপুত্রের জন্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হন্যে হয়ে তাদের আটক করার জন্য খুঁজতে লাগল। চট্টগ্রামে তার অবস্থান আর নিরাপদ নয় আঁচ করতে পেরে অসহায় বেগম খালেদা জিয়া বোরকায় মুখ ঢেকে দুই শিশুপুত্রসহ নদীপথে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছালেন এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে। সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় এসে শান্তিনগরে বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নিলেন। অল্প কিছুদিন বাদে সিদ্ধেশ্বরীতে আরেক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করলেন এবং সেখান থেকেই মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেন। এরপর থেকে দুই শিশুপুত্রসহ ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী ছিলেন প্রায় সাড়ে সাত মাস এবং ১৬ ডিসেম্বর তারিখে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার দিন তিনি মুক্তিলাভ করলেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বামী জিয়াউর রহমান বীর উত্তম খেতাব লাভ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছিলেন। এর বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়ার দুই শিশুপুত্রসহ ৯ মাসব্যাপী বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামকেও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গেই স্মরণে রাখা উচিত। হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আবার সংসার সাজালেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বামী জিয়াউর রহমান কুমিল্লার একটি ব্রিগেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। কিছুদিন পর সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে পদোন্নতিও পেলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে কিছু মধ্যমসারির সেনা কর্মকর্তার অভ্যুত্থানে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। দেশে সামরিক আইন জারি করে তারা।©জয় সিদ্দিকী সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বা নির্দেশসূত্র ভেঙে পড়ে। ©জয় সিদ্দিকী এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি পান।©জয় সিদ্দিকী কিন্তু নানামুখী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যে ১৯৭৫ সালেরই ৩ নভেম্বর তারিখে পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেন এবং শেখ মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপদে দেশত্যাগের ব্যবস্থা করে দেন। চেইন অব কমান্ড ভেঙে এ সময় খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সপরিবারে গৃহবন্দী করেন এবং নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন।©জয় সিদ্দিকী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এটি ছিল দ্বিতীয় বন্দীজীবনের অভিজ্ঞতা এবং এবার স্বামীসহ। পুনরায় স্বামী-সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়লেন তিনি।©জয় সিদ্দিকী কিন্তু নানা কারণে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান সৈনিকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি এবং জনসাধারণও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ঘটনাপরম্পরায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে অভূতপূর্ব এক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে সিপাহী-জনতার বিপ্লব নামে অভিহিত হয়ে থাকে।©জয় সিদ্দিকী সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদিন রাজপথে নেমে আসে এবং তাদের আস্থাভাজন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত করে তার হাতেই দেশে বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিরসনের দায়িত্ব অর্পণ করে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান এবং নিজের ও স্বামী-সন্তানের জীবন-মৃত্যু নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার দোলাচলে এই কয়েকদিনে নতুন ধরনের এক প্রতিকূল পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেন বেগম খালেদা জিয়া। ৭ নভেম্বরের পর আবার সংসার গোছানোয় মন দিলেন বেগম খালেদা জিয়া। স্বামী জেনারেল জিয়া এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে। ©জয় সিদ্দিকী পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশের দুর্দশা দূর করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়তে কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলেন। ১৯৭৮ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন জিয়াউর রহমান। বাকশালের জঞ্জাল সরিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করলেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেন। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই অতিপ্রয়োজনীয় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। ©জয় সিদ্দিকী গণশিক্ষা কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, খালখনন কর্মসূচি, গভীর সমুদ্রে মত্স্য আহরণ, বিদেশে জনশক্তি রফতানি, গার্মেন্ট শিল্প পরীক্ষামূলকভাবে চালু, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসূচির পাইলট কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যুগান্তকারী কিছু উদ্ভাবনী পদক্ষেপ হিসেবে আজো সর্বমহলে প্রশংসিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং তলাবিহীন ঝুড়ির হাস্যস্পদ অপবাদ ঘুচিয়ে সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি সূচিত হতে থাকে। তখনই শুরু হয় আবার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনাকর্মকর্তার গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।©জয় সিদ্দিকী দীর্ঘ একুশ বছরের বর্ণিল দাম্পত্য জীবন হুট করে বিবর্ণ বৈধব্যে পরিণত হয়। সারা জীবনের সব প্রতিকূল অভিজ্ঞতা সইলেও এমনতর নিষ্ঠুরতম অভিজ্ঞতার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। স্বামীর জানাজায় শোকাতুর মানুষের ঢল নামল। ©জয় সিদ্দিকী লাশের ওপর তিনি আছড়ে পড়ে কাঁদলেন। শিশুপুত্ররাও অঝোর ধারায় কাঁদল পিতার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে। এই নিষ্ঠুরতম ও করুণ অভিজ্ঞতা বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে বিরাট এক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, যা পরবর্তী জীবনে তাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে এনেছিল।
গৃহবধু থেকে আপোষহীন নেত্রী:
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে তৎকালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে উত্খাৎ করে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান এরশাদ। সদ্য স্বামী হারানোর শোকে বিহ্বল বেগম খালেদা জিয়া তখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক দুই পুত্রকে আগলে ধরে নিভৃতে দিনযাপন করছিলেন, আর নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত এবং ধ্বংসপ্রায় বিএনপি। এমতাবস্থায় বিএনপির বিভিন্ন স্তরের দলপ্রেমী কিছু নেতা কর্মিদের আহ্ববানে, প্রিয়তম স্বামীর গড়া দল বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ১৯৮২ সালের ৩রা জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন বেগম খালেদা জিয়া, বিসর্জন দেন নিজের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য , জীবন দিয়ে হলেও বিএনপিকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তার এই অটুট মনোবল এবং কঠোর পরিশ্রমে বিএনপি যেন নতুন জীবন পায়।©জয় সিদ্দিকী মূলত বেগম খালেদা জিয়ার মোহময়ী ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণে সেই সময়ের অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সীরা দলে দলে বিএনপির পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। ফলে ছাত্রদল এবং যুবদলের ব্যাপক প্রসার ঘটে দেশব্যাপী। ©জয় সিদ্দিকী অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হতে থাকে। যুবদল ছড়িয়ে পড়ে পাড়ায়-মহল্লায় সর্বত্র। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ©জয় সিদ্দিকী ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন এরই মধ্যে তৎকালীন বিএনপির চেয়ারম্যান বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলতঃ বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় সাত দলীয় ঐক্যজোট এবং শুরু হয় জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সাত দলীয় ঐক্যজোটের সাথে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত যৌথভাবে পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে।©জয় সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ১৫ দল ভেঙ্গে যায়।শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ৮ দল নির্বাচনে যায় এবং নীতিতে অবিচল থাকে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দল তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এরশাদের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকার বিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করে, এরপর ১৯৮৭ সাল থেকে বেগম খালেদা জিয়া শুরু করেন এক দফার "এরশাদ হটাও" আন্দোলন।©জয় সিদ্দিকী স্বৈরাচার এরশাদ তখন তার শাসনকে একটি বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক চেহারা দেয়ার চেষ্টা করতে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য চাটুকার রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ গ্রহণে বিভিন্ন নির্বাচনের আয়োজন করে কিন্তু সেসব নির্বাচন আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট কর্তৃক বর্জনের কারণে তার সব প্রচেষ্টাই ক্রমশ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরশাদ সরকার তখন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞামূলক আইন প্রয়োগ করে খালেদা জিয়ার গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখে এমনকি তিনবার গ্রেফতারও করে খালেদা জিয়াকে।©জয় সিদ্দিকী এতকিছু করেও দমানো যায়নি আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে, তিনি নির্ভীক ভাবে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে যেতে থাকেন এরশাদ সরকার উৎখাত আন্দোলনে। খালেদা জিয়ার দাবির যথার্থতা বুঝতে পেরে এরশাদ হঠাও আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত হতে থাকে এবং দেশব্যাপী শুরু হয় তুমুল বিক্ষোভ এমনকি এরশাদ সরকারের সাথে নৈকট্যের দরুন জন বিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগও বাধ্য হয় পুরায় এ আন্দোলনে যোগ দিতে।©জয় সিদ্দিকী অবশেষে দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০-এ জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।©জয় সিদ্দিকী এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে তিনবার গ্রেফতার সহ শত বাধা, বিপত্তি, নিপীড়ন সত্যেও কখনই আপোষ করেননি বেগম খালেদা জিয়া।©জয় সিদ্দিকী সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে দৃঢ় মনোভাবের সাথে কঠোর নেতৃত্ব দিয়ে “স্বৈরাচার পতন” আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ স্বৈরাচার এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জন করেন চূড়ান্ত বিজয় এবং #আপসহীননেত্রী’র খেতাব।
আপোষহীন নেত্রী থেকে দেশনেত্রী:
দীর্ঘ ৯ বছর একটানা নিরলস ও আপোষহীন সংগ্রামের ফলে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পতন হলো স্বৈরাচার এরশাদের। শুরু হলো বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের তৃতীয় অধ্যয়, যা তাকে নিয়ে যায় আপোষহীন নেত্রী থেকে দেশনেত্রীর আসনে।
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী:
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী:
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় বহু প্রতীক্ষিত সংসদীয় নির্বাচন(পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন), যেটি এখনও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সর্বাধিক অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বৃহত্তম দল-রূপে আবির্ভূত হয় বিএনপি, নীরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ বিএনপির প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন।©জয় সিদ্দিকী এ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া পাঁচটি আসন থেকে এবং শেখ হাসিনা তিনটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন অপরদিকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা ঢাকার দু’টি আসনে পরাজিত হন।
১৯৯১ সালের ১৯শে মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস, এই তারিখে বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম (উপমাহাদেশের দ্বিতীয় মুসলিম) মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অনেকটা রক্ষণশীল বাংলাদেশে নারীদেরকে ঘিরে প্রচলিত সংস্কারের ব্যারিয়ার গুলোকে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন যা বাংলাদেশের নারীদের অগ্রযাত্রায় একটি মাইল ফলক।©জয় সিদ্দিকী
১৯৯১-এর নির্বাচনে বাংলাদেশের বিচক্ষণ জনতা দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বেগম জিয়ার বিচক্ষণ ও আপসহীন নেতৃত্বের পুরস্কার সরূপ স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’কে এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করে বেগম খালেদা জিয়াকে।©জয় সিদ্দিকী
১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি-শাসিত থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় সংবিধানের ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনী বিল ।
১৯সেপ্টেম্বর ১৯৯১, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া ।©জয় সিদ্দিকী
খালেদা জিয়ার প্রথমমেয়াদ(১৯৯১-১৯৯৬)’র শুরুতেই দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি বিস্তীণ অঞ্চলে আঘাত হানে শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস । ত্রাণ ও পূর্ণবাসন সামগ্রীর অপ্রতুলতা সত্বেও তার সরকার দুযোগপূর্ণ পরিস্থিতিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদ(১৯৯১-১৯৯৬)’র উন্নয়ন: ©জয় সিদ্দিকী
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম মেয়াদে মূল্যস্ফীতির হারকে সর্বনিম্ন পযায়ে নামিয়ে আনা এবং শিল্প ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি প্রসারিত করা হয়, যার মাধ্যমে বেসরকারি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যক্তিখাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝরি শিল্পের ক্ষেত্রে। এতে কোনোপ্রকার বাধানিষেধ ছাড়াই শতভাগ বিদেশি মালিকানা ও যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। খালেদা সরকার পশুসম্পদ খাতকে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করে, যার ফলে দেশব্যাপী অসংখ্য গবাদি অ হাঁস-মুরগীর খামার ওঠে। এসময় দেশে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রাকে আংশিক বিনিময়যোগ্য করা হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বোচ্চ পযায়ে পৌছায়। দেশের উন্নয়ন বাজেটে বিদেশি সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়।জয় সিদ্দিকী এর ফলে পাঁচ বছরে উন্নয়ন বাজেটে দেশিয় সম্পদের হিস্যা ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে দেশে প্রথমবারের মতো উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রবত্তন করা হয়, যার মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি, সরকার মুক্ত-বাজার ও বাণিজ্যিক উদারিকরণ নীতিমালার অংশ হিসেবে আমদানি পর্যায়ে ব্যাপক হারে শুল্ক হ্রাস করা হয়। এসময়ে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে খাল-খনন কর্মসূচি পুনরায় চালু করা হয়। দেশের আইন ও বিধিবিধান অব্যাহতভাবে হাল-নাগাদ করার লক্ষ্যে খালেদা সরকার একটি স্থায়ী আইন কমিশন গঠন করে। এসময়ে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল সপ্তম সার্ক শীর্ষ সন্মেলন আয়োজন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সার্কের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভামমূতি উজ্জলতর হয়।©জয় সিদ্দিকী
শিক্ষ্যা খাতের উন্নয়ন: ©জয় সিদ্দিকী
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে (১৯৯০-৯৫) শিক্ষা খাতের অনুকূলে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয় যার ৭০ শতাংশই ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপ-খাতের জন্য। খালেদা সরকার একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং শিক্ষা উৎসাহিত করার জন্য ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা অনুমোদন করে। দেশের মানুষের দ্রুততম সময়ে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীনে একটি পৃথক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ জুলাই থেকে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষালাভে আগ্রহী করে তুলতে খালেদ সরকার ১৯৯৩ সালে ‘শিক্ষার বিনিময় খাদ্য’ কর্মসূচি চালু করে। পল্পী অঞ্চলে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয় এবং মাধ্যমিক পর্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য দেশব্যাপী একটি উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়।©জয় সিদ্দিকী
যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক এর উন্নয়ন: ©জয় সিদ্দিকী
১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর যমুনা বহুমূখী সেতুর ভৌত– নির্মাণ শুরু করা, মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, চট্টগ্রাম একটি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ। এসময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের প্রস্ততিমূলক কাজ সম্পন্ন করা হয়। এবং এগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে চীনা ও কোরীয় সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশের ইতিহাস প্রথমবার সিএনএন ও বিসিসি’র মতো স্যাটেলাইট চ্যানেলকে সম্প্রচার করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং ধারাবাহিকতায় অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলও দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। বাংলাদেশের মোবাইল টেলিফোনের যাত্রাও এসময়ে শুরু হয়।©জয় সিদ্দিকী
উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ: ©জয় সিদ্দিকী
চাকুরীজীবিদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত জাতীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স-সীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা; পেনশনের বিধান করা; শ্রমিকদের জন্য ১৭টি খাতে নূন্যতম মজুরি নিধারন তদারকির জন্য সিকিউরিটিজ নিধারণ; বঙ্গোপসাগর জলদস্যুতা ও চোরাচালান হ্রাসে কোস্ট-গাড বাহিনী প্রতিষ্ঠা; দেশের শেয়ারবাজার তদারকির জন্য সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন।©জয় সিদ্দিকী #চলবে
লেখক : জয় সিদ্দিকী, যুগ্ন সাধাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, ৮নং ওয়ার্ড যশোর নগর।
হার না মানা বেগম জিয়া
Comments