একনায়কদের মনস্তত্ত্ব - বিশ্বের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় একনায়কের রহস্যপূর্ণ মনের গহীনে সিআইএ’র অভিযান
![]() |
একনায়কদের মনস্তত্ত্ব - সিআইএ |
একনায়কদের মনস্তত্ত্ব
সিআইএ একসময়ে বিশ্বের কয়েকজন নেতৃস্থানীয়
একনায়কের রহস্যপূর্ণ মনের খোঁজখবর নিতে গোপন অনুসন্ধান চালিয়েছিল। তাদের সেই অবিশ্বাস্য,
গোপন প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করেছেন ডেইভ গিলসন।
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত একটি
গোপন গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বড় বৈশিষ্ট্য
হলো অটিজম।ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তোলা পুতিনের ছবির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন মার্কিন
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষকেরা। তারা দেখতে পান যে, রুশ রাষ্ট্রপ্রধানের স্নায়বিক
অস্বাভাবিকতা বিদ্যমান। নেতৃস্থানীয় স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এটাকে চিহ্নিত করেছেন অ্যাসপার্জার্স
সিনড্রোম (Asperger's syndrome) হিসেবে। অটিজমঘটিত এই সমস্যা পুতিনের যাবতীয় সিদ্ধান্তকেই
প্রভাবিত করেছে।অবশ্য পুতিনের মুখপাত্র এই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের অভিমত
এমন নির্বুদ্ধিতা যে, এটা কোনো মন্তব্য করারও অযোগ্য।’
তবে রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে বিদেশের
নেতাদের রোগ নির্ণয়ের জন্য গোয়েন্দাদের এই প্রয়াসই প্রথম নয়। সিআইএ কর্তৃক আন্তর্জাতিক
ব্যক্তিত্বদের মনস্তাত্ত্বিক তথ্যগুলো সংরক্ষণের ইতিহাস দীর্ঘ। এসব তথ্য বিশুদ্ধতার
দিক দিয়ে একই মাত্রার নয়। এ ক্ষেত্রে সিআইএ যেসব চেষ্টা চালিয়েছিল, এর কিছু নমুনা উপভোগ্য
হিসেবে এখানে দেয়া হলো।
অ্যাডলফ হিটলার
১৯৪৩ সাল। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
তখনো জন্ম হয়নি সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএর। এর পূর্বসুরি গোয়েন্দা সংস্থার
নাম অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস (ওএসএস)। তারা নিয়োগ করলেন হার্ভার্ড সাইকোলজিক্যাল
ক্লিনিকের হেনরি এ মারেকে। তার দায়িত্ব ছিল দূর থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হিটলারের
ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন করা। সহকর্মীদের নিয়ে মারে তৈরি করলেন ২৪০ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট।
সংশ্লিষ্ট সব তথ্যই ছিল এতে।
হিটলারের মনস্তাত্ত্বিক রোগের লক্ষণ
নিজেকে অনিরাপদ মনে করা, পুরুষত্বহীনতায়
ভোগা, নিজেকেই ব্যথা বা যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়া, নিজের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা এবং
আত্মহত্যার প্রবণতা।
হিটলারসংক্রান্ত রিপোর্টটি থেকে উদ্ধৃতি
: ‘মনস্তত্ত্ববিদদের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদ প্রায় নেই যে, হিটলারের ব্যক্তিত্ব নেতিবাচক
সক্রিয়তার নজির। এর লক্ষণ হিসেবে দেখা গেছে, হিটলার তার পূর্বতন প্রতিবন্ধকতা, দুর্বলতা
ও নিগ্রহ বা লাঞ্ছনা কাটিয়ে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে চরম প্রয়াস চালিয়ে থাকেন। তিনি আঘাত
পেলে কিংবা তার অহঙ্কারের প্রতি অবমাননা বোধ করলে প্রতিশোধ নেয়ার প্রয়াস পান।’
হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক থাকাকালে
হিস্টিরিয়াজনিত অন্ধত্বে ভুগেছিলেন। এই মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতার সম্পর্ক আছে তার ‘জার্মান
মাতা’র (জার্মানির
রাষ্ট্রশক্তি) চূড়ান্ত পরাজয়ের সাথে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নতিস্বীকার করার খবর
শুনে তিনি স্বদেশের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তখন হঠাৎ তিনি ফিরে পেলেন
দৃষ্টিশক্তি।
আলোচ্য রেকর্ডপত্রে ‘ফুয়েরার’-এর সম্ভাব্য চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আটটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলো, উন্মাদ হয়ে যাওয়া, যুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করা, ইহুদি ঘাতকের হাতে প্রাণ
দেয়ার পাঁয়তারা করা এবং আত্মহত্যা করা।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিটলার প্রায় সময়ে প্রতিজ্ঞা
করতেন যে, তার পরিকল্পনা কার্যকর না হলে আত্মহত্যা করবেনই। তবে এটা যদি করেনও, তিনি
তা করবেন সর্বশেষ মুহূর্তে এবং সম্ভাব্য সর্বাপেক্ষা নাটকীয় ভঙ্গিতে এটা করা হবে। আমাদের
জন্য তা হবে অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি।’
নিকিতা ক্রুশ্চেভ
১৯৬১ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান
রাশিয়ার পূর্বসূরি) প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সাথে বৈঠকে মিলিত হন। এর প্রাক্কালে সিআইএ তার সম্পর্কে
তথ্য সংগ্রহ করে। ক্রুশ্চেভ সম্পর্কিত গোয়েন্দা তথ্যের ফাইল পড়তে গিয়ে কেনেডি সিআইএর
‘পার্সোনালিটি প্রোফাইল’, বিশেষ
করে ‘বিদেশী নেতাদের সম্পর্কিত অশালীন গোপন তথ্য’-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এদিকে, সোভিয়েত গোয়েন্দারাও মার্কিন প্রেসিডেন্ট
কেনেডির ব্যাপারে নানা তথ্য জোগাড় করে ফাইল বানিয়ে ফেলেছিল। এতে তাকে ‘দৃষ্টান্ত স্থানীয়
বাস্তববাদী’ হিসেবে অভিহিত
করা হয়, যার ‘উদারতাবাদ বরং আপেক্ষিক।’
রোগ নির্ণয়
সিআইএর দৃষ্টিতে ক্রুশ্চেভ ছিলেন অপরিশীলিত,
চাষাভুষা ধরনের লোক যিনি চাইতেন এমন ব্যক্তি হতে, যার ব্যাপারে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব
নয় এবং যিনি দু’মুখো স্বভাবের।
সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি : ক্রুশ্চেভ
সামাজিক বা নৈতিক বিধিনিষেধমুক্ত দুর্বল অভিনেতাতুল্য ব্যক্তি, যিনি মাঝে মাঝে তার
বক্তব্য বিষয়গুলো তুলে ধরেন চাষির বাড়ির রসিকতার সাথে। কোনো কোনো উপলক্ষে তার ব্যক্তিগত
মর্যাদাবোধ দেখা যায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।’
আরো বলা হয়, তিনি যদি দেখেন কিংবা মনে করেন
যে, তার নিজের প্রতি অথবা তার রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা তার জাতির প্রতি অমর্যাদা বা
অবহেলা করা হচ্ছে, তাহলে তিনি তীব্রভাবে স্পর্শকাতরতা প্রকাশ করে থাকেন। তার মতে, ব্যক্তি
হিসেবে তার সাথে রাজনৈতিক বিশ্বাস বা তার দেশ অবিচ্ছেদ্য।’
গোয়েন্দা তথ্যে আরো উল্লেখ ছিল অসাধারণ খোলামনের
অধিকারী হতে পারেন ক্রুশ্চেভ। তার নিজের চোখে তিনি অসাধারণ সৎমানুষ। তবে তিনি পরিকল্পিতভাবে
অন্যকে ধোঁকা দেয়ার কাজে দক্ষ। তিনি আসলেই দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে কথা বলছেন কি না, অথবা
তার প্রকৃত অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা লুকাচ্ছেন কি না, প্রায় সময়ে এটা বোঝা
কঠিন হয়ে পড়ে।’
‘এটা বলাও সোজা
নয় যে, ক্রুশ্চেভের ক্রোধ প্রকৃত, নাকি তিনি রেগে যাওয়ার নিছক ভান করছেন। যখন ক্লান্ত
হয়ে পড়েন, তিনি তার সাংঘাতিক মেজাজটা তেমন লুকাতে পারেন না।’
ফিদেল ক্যাস্ট্রো
কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লব
ঘটিয়ে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৯ সালে। দুই বছর না যেতেই সিআইএ তার ওপর গোপন প্রতিবেদন
তৈরি করে ফেলে।
রোগের লক্ষণ
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মাথায় ছিট আছে, এমনটা
বলা যাচ্ছে না টেকনিক্যাল কারণে। তবে তার স্নায়বিক সমস্যা তীব্র। তার নেই স্থিরতা।
ফলে কোনো কোনো ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপে তিনি কাবু হয়ে পড়তে পারেন।
ক্যাস্ট্রোসংক্রান্ত রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি
: তার ব্যক্তিত্বের স্নায়বিক বিষয়ের প্রধান উপাদান হলো, তার ক্ষমতার লোভ এবং জনগণ কর্তৃক
তার স্বীকৃতি ও প্রশংসা লাভের তাগিদ।
‘যখনই কোনো বিষয়ে
তার নিজের ধারণার সামান্য সমালোচনাও হয়ে থাকে, তিনি এত বেশি আবেগপ্রবণ ও অস্থির হয়ে
পড়েন যে, বাস্তবতার সাথে সংস্পর্শ কিছুটা হলেও হারিয়ে ফেলেন।
‘ক্যাস্ট্রো অনবরত
তাগিদ বোধ করেন যে, তার বিদ্রোহী মনোভাব থাকা প্রয়োজন; তাকে একজন শত্রু পেতে হবে এবং
বিদ্যমান কর্তৃপক্ষকে ছুড়ে ফেলার মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে হবে।
সিআইএ রিপোর্টে আরো মন্তব্য করা হয়েছিল
: ক্যাস্ট্রোর অহংবোধই তার জন্য Achilles' Heel হয়ে দাঁড়াবে।’ অর্থাৎ এটা দৃশ্যত ক্ষুদ্র বিষয় হলেও তার জন্য বৃহৎ সমস্যার কারণ হতে
পারে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি
গাদ্দাফি লিবিয়ার মার্কিনপন্থী বাদশাহ ইদরিসকে
উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন ১৯৬৯ সালে। আশির দশকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের
আমলে সিআইএ ‘লিবিয়ার লৌহমানব’-এর উল্টাপাল্টা
আচরণের হদিস বের করতে প্রয়াস পেয়েছিল। সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এ ব্যাপারে উদ্ধৃতি দিয়েছেন
সিআইএ প্রতিবেদনের। তার বইটির নাম Veil : The Secret Wars of the CIA.
রোগের লক্ষণ
‘যদিও বিশ্বাস
করা হয় যে, গাদ্দাফির মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা আছে, আসলে তা নয়। অবশ্য তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের
ব্যাপারে এমন একটা সমস্যার কাছাকাছি অবস্থায় উপনীত হয়েছেন।’
রিপোর্টের উদ্ধৃতি : প্রচণ্ড চাপের শিকার
হলে মুয়াম্মার গাদ্দাফি অদ্ভুত আচরণ করে থাকেন। তখন তার বিচার বিবেচনায় ভুল হতে পারে।
‘তার আচরণ মাঝবয়সী মানুষের সঙ্কটের মতো, বলা যায়।’
Comments