মুসোলিনির মৃত্যু
![]() |
বেনিটো অ্যামিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি |
মুসোলিনির
মৃত্যু
Collected
মুসোলিনি। পুরো
নাম বেনিটো অ্যামিলকেয়ার আন্দ্রে
মুসোলিনি। জন্ম
১৮৮৩ সালের ২৯ জুলাই। নিহত
হন ১৯৪৫ সালের ২৮
এপ্রিল। পেশাগতভাবে
ছিলেন ইতালীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক,
ঔপন্যাসিক, শিক্ষক ও সৈনিক। নেতৃত্ব
দেন ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির। তাকে
বিবেচনা করা হয় ফ্যাসিজম
সূচনার মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে।১৯২২ সালে হন ইতালির
৪০তম প্রধানমন্ত্রী। ১৯২৫
সাল থেকে ‘ইল ডুসে’
বা ‘দ্য লিডার’ উপাধি
ব্যবহার করতে শুরু করেন। ডুচে
হচ্ছে ইতালীয় খেতাব, যার
অর্থ ‘নেতা’। যেমন
হিটলার গ্রহণ করেন তার
‘ফুয়েরার’ খেতাব। ফুয়েরার
শব্দের অর্থও ‘নেতা’।
ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির নেতা মুসোলিনিকে ফ্যাসিস্টরা
তাদের ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের নেতা হিসেবে ধরে
নেয়। সরকারপ্রধান
ও ফ্যাসিজমের নেতা হিসেবে তিনি
১৯২৫ সালে ইতালিতে যে
ফ্যাসিজমের প্রতিষ্ঠা করেন, তা ধরে
রাখেন ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। তার
এই অবস্থান ছিল অন্য ফ্যাসিস্টদের
জন্য এক মডেল।
অন্য ফ্যাসিস্টেরা তার এই মডেল
মেনে নেন। ১৯৩৬
সালের পর মুসোলিনির সরকারি
পদবি ছিল : ‘হিজ এক্সেলেন্সি
বেনিটো মুসোলিনি, হেড অব গভর্নমেন্ট,
ডুচে অব ফ্যাসিজম, অ্যান্ড
ফাউন্ডার অব দ্য এম্পায়ার’। তিনি
সৃষ্টি ও অধিকার করেছিলেন
একটি বিশেষ সামরিক পদ
: ‘ফার্স্ট মার্শাল অব দ্য এম্পায়ার’। রাজার
পদমর্যাদার তার আরেক উপাধি
ছিল : ‘ভিক্টর তৃতীয় ইমানুয়েল’। এ
উপাধি সূত্রে তিনি ইতালির
সামরিক বাহিনীর ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণাধিকার
প্রয়োগ করতেন। ১৯৪৩
সালে ক্ষমতা থেকে অপসারিত
হন। এরপর
তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বল্পকালের
জন্য তিনি ছিলেন ‘ইতালিয়ান
সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’-এর নেতা।ইতালিতে
ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন
মুসোলিনি। এই
ফ্যাসিবাদের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল
: ন্যাশনালিজম, করপোরেটিজম, ন্যাশনাল সিন্ডিক্যালিজম, এক্সপানশন্যালিজম, সোস্যাল প্রগ্রেস, ‘অ্যান্টিসোস্যালিজম। আর
এর সাথে সম্মিলন ঘটানো
হয় সেন্সরশিপ অব সাববারসিভ’ এবং
‘স্টেট প্রপাগান্ডার’। মুসোলিনি
তার ফ্যাসিবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরের
বছরগুলোতে অনেক রাজনীতিকের ওপর
যেমনি প্রভাব সৃষ্টি করতে
পেরেছিলেন, তেমনি অনেকের আশীর্বাদপুষ্টও
হয়েছিলেন। ১৯৪০
সালের ১০ জুন তার
নেতৃত্বে ইতালি অক্ষশক্তির পক্ষে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়।
১৯৪৩ সালের ২৪ জুলাইয়ে
মুসোলিনি ‘গ্র্যান্ড কাউন্সির অব ফ্যাসিজমের’ ভোটে
হেরে যান। এই
কাউন্সিল ছিল ইতালিতে মুসোলিনির
ফ্যাসিস্ট সরকারের মূল কমিটি।
এ কমিটিই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর
ওপর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ বজায়
রাখত। দলীয়
কমিটি হিসেবে এ কাউন্সিল
গঠন করা হয় ১৯২৩
সালে। তা
রাষ্ট্রীয় কমিটিতে রূপ নেয় ১৯২৮
সালের ৯ ডিসেম্বরে।
ভোটে হেরে যাওয়ার পরদিন
রাজা তাকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের
দুই মাসেরও কম সময়
পর ১৯৪৩ সালের ১২
সেপ্টেম্বর জার্মান স্পেশাল ফোর্সের পরিচালিত ‘গ্র্যান্ড সাসো রেইডের’ মাধ্যমে
মুসোলিনি মুক্ত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের আদেশে
এই রেইড বা অভিযান
পরিচালিত হয়। জার্মান
প্যারাট্রুপার ও ওয়াফেন এসএস
ফোর্স এই অভিযান চালায়। সশস্ত্র
ওয়াফেন এসএস ফোর্স ছিল
থার্ড রাইখের বহুজাতিক সামরিক
বাহিনী। উল্লেখ্য,
নাৎসি জার্মানি থার্ড রাইখ নামেও
পরিচিত ছিল।মুক্ত
হওয়ার পর মৃত্যুর আগ
পর্যন্ত মুসোলিনি ইতালির অংশবিশেষ নিয়ে
গঠিত ‘ইতালিয়ান সোস্যাল রিপাবলিকের’ প্রধান ছিলেন।
এই রিপাবলিক মিত্র বাহিনী দখল
করেনি। এটি
ছিল জার্মানির একটি পুতুল রাষ্ট্র। এর
স্থায়িত্বকাল ১৯৪৩-৪৫। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলের শেষ
দিকে ইতালির যুদ্ধে চূড়ান্ত
পরাজয়ের আগে মুসোলিনি সুইজারল্যান্ডে
পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অগ্রসরমান
মিত্র বাহিনী এড়িয়ে তিনি
পিছু হটে চলা একটি
জার্মান সামরিক বহরের সাথে
আল্পস পর্বতমালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই
কনভয়ের বা বহরের সাথে
পালিয়ে যাওয়ার পথে তিনি
স্ত্রীসহ আরো অনেকেই ধরা
পড়েন ইতালীয় পার্টিশান বা
প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে। প্রতিরোধ
বাহিনী এই কনভয় বা
বহর থামিয়ে দেয় ডুঙ্গো
গ্রামে। এ
সময় মুসোলিনি একটি ট্রাকের পেছনে
ছিলেন। পরনে
ছিল পাট্টা কাপড়ের প্যান্ট। গায়ে
ওভারকোট। কমিউনিস্ট
নেতৃত্বাধীন পার্টিশান নেতারা গোপনে মুসোলিনি
ও তার সাথের ১৫
জন শীর্ষস্থানীয় ফ্যাসিস্ট নেতাকে মেরে ফেলার
সিদ্ধান্ত নেন। কোনো
বিচার না করেই ১৯৪৫
সালের ২৯ জুলাই সেখানেই
তাদের মেরে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলটি
ছিল লেইক কমো।
মেরে ফেলার পর তাদের
লাশ নিয়ে আসা হয়
ইতালির মিলানে। সেখানে
তার ও স্ত্রীর লাশসহ
আরো অনেকের লাশ একটি
‘এসো গ্যাস’ স্টেশনে উল্টো
করে ঝুলিয়ে রাখা হয়
জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য। সেই
সাথে তাদের প্রতি ঘৃণা
প্রকাশের জন্য।
যেভাবে
মৃত্যু
মুসোলিনি
তার ক্ষমতার শেষ সাত দিন
কাটান মিলানে। মিলানই
ছিল তার ক্ষমতায় আসীন
হওয়ার স্থান। ১৯৪৫
সালের ২০ এপ্রিল তিনি
তার সরকারি অফিস বাতিল
করে দেন। ২১
এপ্রিল মিত্র বাহিনীর হাতে
ধরা পড়েন বুলুগনা।
একই দিনে ফ্যাসিস্ট প্রধান
আরপিনাটিকে হত্যা করা হয়। মুসোলিনির
বন্ধুবান্ধব ও কর্মকর্তারা চেষ্টা
করেন তাকে স্পেনে পালিয়ে
যেতে রাজি করাতে।
কিন্তু তিনি দেশ ছাড়তে
অস্বীকার করেন। মুসোলিনি
লিবারেশন কমিটির সোস্যালিস্ট পার্টির
কাছে একটি সমঝোতা প্রস্তাব
দেন। প্রস্তাবটি
পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হয়।
২৪ এপ্রিল কার্ডিনাল সাস্টারের
সাথে যোগাযোগ করা হলো।
তাতে কোনো ফলোদয় হলো
না। ডুসে
এবার নিশ্চিত হয়ে পড়েন তাকে
নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া
ছাড়া আর কোনো উপায়
নেই। ধরে
নিলেন, তাকে নিয়তির কাছে
আত্মসমর্পণ করতেই হবে।
তিনি কার্ডিনালকে বললেন: ‘আই হেভ নো
ইলিউশনস’। আর্চবিশপ
প্রাসাদে লিবারেশন কমিটির একটি বৈঠক
হলো। সেখানে
তারা তাকে জানাল, মিত্র
বাহিনীর হাতে ইতালিতে জার্মানদের
আসন্ন আত্মসমর্পণের কথা। তখন
মুসোলিনির প্রতিক্রিয়া ছিল : ‘দে হেভ
অলওয়েজ ট্রিটেড আস লাইক সেøভস, অ্যান্ড নাউ
বিট্রে আস’।২৫ এপ্রিল তিনি জার্মান
কনভয়ের সাথে মিলান ছাড়েন। উদ্দেশ্য
ভ্যাটেলিন যাবেন। সেখান
থেকে পালিয়ে যাবেন সুইজারল্যান্ডে। এই
জার্মান কনভয় বা বহরে
ছিল কিছু কার ও
কিছু সশস্ত্র জার্মান সামরিক গাড়ি।
পেছন দিকটায় ছিলেন মুসোলিনির
স্ত্রী ক্লারা পেটাচি ও
তার পরিবার। কমোতে
এসে তারা কথা বলছিলেন
রাতের খাবারের ব্যাপারে। ডুসে
লিখেন স্ত্রী র্যাসেলকে
লেখা তার সবশেষ চিঠি। চিঠিতে
তাকে সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার অনুরোধ
করা হয়। চিঠিতে
তিনি স্বাক্ষর করেন : ‘ইউর বেনিটো, কমো,
২৭ এপ্রিল, ১৯৪৫, ফ্যাসিস্ট যুগের
১৩তম বছর।’২৬ এপ্রিল তারা কমো
ছাড়েন। যাত্রাবিরতি
করেন মেনাজিওতে। প্যাভোলিনির
নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট সৈন্যদের একটি দল মিলান
ছাড়ে তাদের নেতার সাথে
যোগ দেয়ার জন্য।
তাদের কাছে খবর পৌঁছে
লিবারেশন কমিটি সেই সব
ফ্যাসিস্টদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ডিক্রি জারি
করেছে, যারা ১৯২২ সালের
বিদ্রোহের জন্য দায়ী ছিল
এবং যারা ১৯৪৩ সালের
৮ সেপ্টেম্বরের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।২৭ এপ্রিল প্যাভোলিনি মুসোলিনির
কাছে গিয়ে পৌঁছেন।
তার সাথে ছিলেন মুসোলিনির
সাবেক স্ত্রী অ্যাঞ্জেলা কুর্টি। একই
সময়ে জার্মান অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট ইউনিট লে. ফলমেয়ারের
নেতৃত্বে টাইরয়েল যাওয়ার পথে মেনাজিও
গিয়ে পৌঁছেন। ডুসে
সিদ্ধান্ত নেন জার্মান মিত্রদের
সাথে থেকে উত্তর দিকে
এগিয়ে গিয়ে গ্রেফতার এড়িয়ে
ইতালিতেই থাকতে। সকাল
৭টার দিকে তারা পৌঁছেন
ম্যাসোতে, যেখানে পার্টিশানেরা রাস্তা
বন্ধ করে রেখেছে।
লে. ফলমেয়োর গেলেন ৫২তম গ্যারিবল্ডি
ব্রিগেডের কমান্ডার কাউন্ট পিয়ের লুইগি
বেলিনি ডেলি স্টিলির সাথে
সমঝোতা করার জন্য।
পার্টিশানেরা জার্মানদের চলে যেতে দিতে
সম্মত হয়, কিন্তু ইতালীয়দের
যেতে দিতে রাজি হয়নি। জার্মানেরা
মুসোলিনিকে একটি জার্মান গ্রেটকোট
ও একটি হেলমেট পরিয়ে
একটি ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে রাখে। রাত
৩টার সময় জার্মান বহর
মুসোলিনিকে নিয়ে এখান থেকে
রওনা হয়। বহরটি
ডুঙ্গো গ্রামে থামিয়ে দেয়
পার্টিশানেরা। এরপর
পুরো বহরটি সার্চ করে। এরা
সহজেই ইল ডুসেকে পেয়ে
যায়। কারণ
তখনো তার পরনে ছিল
জেনারেলের লাল ডোরার রাইডিং
প্যান্ট। কিংবা
হতে পারে, তার লোকানোর
খবরটি কেউ ফাঁস করে
দিয়েছিল পার্টিশানদের কাছে। এরপর
ক্লারা পেটাচি ও তার
ভাই মার্সেলো পেটাচিকেও আটক করা হয়। কিন্তু
ক্লারার পরিচয় তখনো চিহ্নিত
করা হয়নি। ডুসের
আটক করার খবরটি জানানো
হয় পার্টিশান লিবারেশন কমিটিকে।
কমিটি
খবরটি পাওয়ার সাথে সাথে
কড়া আদেশ দেয় আটক
মুসোলিনির প্রতি ভালো আচরণ
করার জন্য। এবং
এমনকি পালিয়ে যেতে চাইলেও
যেন তার ওপর গুলি
চালানো না হয়।
২৮ এপ্রিল শনিবার রাত
দেড়টায় কাউন্ট বেলিনি চেষ্টা
চালান তার বন্দীদের কমো
এলাকায় ফিরিয়ে আনতে।
এক সময় ডুসের শরীরে
ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়, যাতে
করে মনে করা হয়
তিনি একজন আহত পার্টিশান। আমেরিকান
ফার্স্ট আর্মার্ড ডিভিশনের এগিয়ে আসার খবর
পেয়ে এবং সেই সাথে
গোলাগুলির খবর পেয়ে তারা
সিদ্ধান্ত নেন মেজেগ্রার দিকে
চলে যেতে। মেজেগ্রার
এক খামার বাড়িতে মুসোলিনি
ও তার স্ত্রী তাদের
জীবনের শেষ রাতটি কাটান।লিবারেশন
কমিটির সিদ্ধান্ত সতর্কতার সাথে গোপন রাখা
হয়। তার
পরও এটি জানা ছিল,
কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ও ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রীর
টগলিয়াট্টি আদেশ দিয়েছেন ডুসেকে
মেরে ফেলতে। ন্যাশনাল
লিবারেশন কমিটির নামে এই
গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়
কর্নেল ভেলেরিওর ওপর। তিনি
রাত ২টায় পৌঁছান ডুঙ্গো
গ্রামে। তখন
কমিউনিস্ট লিডার ও পার্টিশান
লিডারের মধ্যে এক ধরনের
দ্বন্দ্ব চলছিল। কর্নেল
ভেলেরিও তাদের কাছে বন্দী
ফ্যাসিস্টদের তালিকা চান।
এরপর তিনি তাদের জানান
তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে
মুসোলিনিকে মেরে ফেলতে।
তিনি এই তালিকা থেকে
হত্যার জন্য ১৫ জনের
নাম বাছাই করেন।
লিবারেশন কমিটি মুসোলিনির সাথে
১৫ জন ফ্যাসিস্টকে হত্যার
সিদ্ধান্ত নেয়। এই
১৫ জনের মধ্যে ক্লারা
পেটাচি ও তার ভাইয়ের
নাম ছিল না।
তাদেরকেও মুসোলিনির সাথে গুলি করে
মারা হয়।যারা এই হত্যার শিকার
তাদের নামের তালিকা নিচে
দেয়া হলো :
০১. বেনিটো মুসোলিনি, ইল
ডুসে; ০২. ফ্রান্সেসকো বারাকো,
ক্যাবিনেট অফিসের আন্ডার সেক্রেটারি;
০৩. ফার্নান্দো মেজাসোম্মা, পপুলার মিনিস্টার কালচার
(প্রপাগান্ডা মিনিস্টার); ০৪. নিকোলো বোমবাচ্চি,
মুসোলিনির বন্ধু ও ইন্টেরিয়র
মিনিস্টার; ০৫. লুইগি গাট্টি,
মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের পর ডুসের প্রাইভেট
সেক্রেটারি; ০৬. পিসেন্টি লিবারেনি,
যোগাযোগমন্ত্রী; ০৭. অ্যালেসান্দ্রো প্যাভোলিনি,
সাবেক পপুলার কালচার মিনিস্টার,
রোমের মেসেজারো পত্রিকার সম্পাদক, ০৮. পাওলো জারবিনো,
ইন্টেরিয়র মিনিস্টার; ০৯. রুজারো রোমানো,
গণপূর্তমন্ত্রী; ১০. পাওলো পোর্টা,
ফ্যাসিস্ট পার্টির লম্বার্ডি শাখার প্রধান; ১১.
আলপ্রেডো কপোলো, বুলুগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের
রেক্টর; ১২. আর্নেস্তো ডেকুয়ানো,
স্টেফানি অ্যাজেন্সির ডিরেক্টর; ১৩. মারিও নুদি,
ফ্যাসিস্ট অ্যাগ্রিকালচার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট; ১৪. কর্নেল ভিটো
ক্যাসারিনোভো, মুসোলিনের অ্যাডজুট্যান্ট; ১৫. পিয়েট্রো ক্যালিস্ত্রি,
এয়ার ফোর্স পাইলট, ডুসের
সাথে তার কোনো সম্পর্ক
ছিল না; ১৬. ইদ্রেনো
উতিমপার্গে, কেউ কেউ বলেন
তিনি ছিলেন ব্ল্যাকশার্ট লিডারের
একমাত্র সাংবাদিক; ১৭. আর্চিলি স্টারাচি,
ফ্যাসিস্ট পার্টির সেক্রেটারি ১৯৩১-১৯৩৯, তাকে
মিলানে গ্রেফতার করার পর ঘটনাস্থলেই
মেরে ফেলা হয়।
একটি সূত্র মতে, তার
লাশ ঝুলানো হয় ডুসের
বাম পাশে; ১৮. ক্লারা
পেটাচি, মুসোলিনির স্ত্রী, তিনি মুসোলিনিকে ছেড়ে
কোথাও যেতে অস্বীকার করেন।
ক্লারা
ও তার ভাই মার্সেলো
পেটাচি মুসোলিনির বহর অনুসরণ করে
আল্পস অভিমুখে যান। মুসোলিনিকে
গ্রেফতারের পর তার সাথে
ক্লারা পেটেচির সাক্ষাৎ হয়। মুসোলিনিকে
জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায়
তাকে গুলি করে মারা
হয়। তার
ভাই উল্লিখিত ১৫ জনের সাথেই
আটক হন। কিন্তু
পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় তিনি
লেক কমোতে ঝাঁপ দেন। এ
সময় তিনি গুলিতে নিহত
হন।
২৭ এপ্রিল পালিয়ে যাওয়ার
পথে লেক কমোর কাছে
মুসোলিনি তার স্ত্রী ক্লারা
পেটাচিকে পথে আটক করেন
কমিউনিস্ট পার্টিশান ভেলেরিও এবং ভেল্লিনি।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির সমর্থক
ইতালির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পার্টিশান বাহিনী
গঠন করে। এসব
পার্টিশান ফোর্স জন্ম দেয়
ইতালি প্রতিরোধ আন্দোলনের। এটি
পার্টিশান রেজিস্ট্যান্স নামেও পরিচিত।
পার্টিশান ফোর্সের বায়ান্নতম গ্যারিবল্ডি ব্রিগেডের রাজনৈতিক শিক্ষা ও সংগঠনের
তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত রাজনৈতিক কর্মকর্তা ‘পলিটিক্যাল কমিশার’ আরবানো ল্যাজ্জারো ক্লারা
ও তার ভাইকে শনাক্ত
করেন। লেইক
কমোর লাগোয়া গ্রাম ডুঙ্গোতে
তারা ধরা পড়েন।
সুইজারল্যান্ড থেকে বিমানে স্পেনে
চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল
তাদের। এ
সময় ক্লারার ভাই তাকে একজন
স্পেনীয় কনসাল হিসেবে পরিচয়
দেন। আগেই
উল্লেখ করা হয়েছে, মুসোলিনি
পালাচ্ছিলেন পিছু হটে চলা
জার্মান বাহিনীর একটি বহরের সাথে। তিনি
যখন পরিচয় গোপন করার
জন্য জার্মান বাহিনীর ইউনিফর্ম পরছিলেন, তখন তাকে গ্রেফতার
করা হয়। আটক
ব্যক্তিদের কমোতে নেয়ার কয়েকবার
চেষ্টার পর, শেষ পর্যন্ত
তাদের নেয়া হয় মেজেগ্রাতে। ইতালির
লম্বার্ডি অঞ্চলের কমো প্রদেশের একটি
পৌরশহর বা কমিউন হচ্ছে
মেজেগ্রা। এরা
সেখানে তাদের জীবনের শেষ
রাত কাটান ডি মারিয়া
পরিবারের একটি ঘরে।
পর দিন মুসোলিনি ও
ক্লারা পেটাচিকে বিনা বিচারে হত্যা
করা হয়। তাদের
সাথে হত্যা করা হয়
তাদের সাথে থাকা ১৫
জনের বেশির ভাগকেই।
বিশেষত তাদের মধ্যে ছিলেন
ইটালিয়ান সোস্যাল রিপাবলিকের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা।
তাদের গুলি করে মারা
হয় ছোট্ট গ্রাম গুলিনো
মেজেগ্রায়।
ঘটনার
ব্যাপারে সরকারের দেয়া ভাষ্য মতে,
এই শুটিং পরিচালনা করেন
কর্র্নেল ভ্যালেরিও। তার
আসল নাম ছিল ওয়াল্টার
অদিসিও। তিনি
ছিলেন কমিউনিস্ট দলীয় কমান্ডার।
মুসোলিনিকে হত্যা করার আদেশ
তাকে দেয় ন্যাশনাল লিবারেশন
কমিটি। যে
কক্ষে মুসোলিনি ও অন্য ফ্যাসিবাদীদের
আটকে রাখা হয়েছিল সে
কক্ষে অদিসিও প্রবেশ করে
ঘোষণা দেন : ‘আমি তোমাদের
উদ্ধার করতে এসেছি।....
তোমাদের কারো কাছে কি
কোনো অস্ত্র আছে?’ এরপর
তিনি তাদের গাড়িতে তুলে
গাড়ি একটু দূরে নিয়ে
যাওয়া হয়। গাড়ি
থামিয়ে তিনি এদের গাড়ি
থেকে নামতে আদেশ দেন। যখন
তাদের একটি খোলা জায়গায়
নিয়ে গিয়ে একটি পাথরের
দেয়ালের পাশে দাঁড়াতে বলা
হলো, পেটাচি মুসোলিনিকে বুকে
জড়িয়ে ধরেন এবং তার
কাছ থেকে দূরে সরে
যেতে অস্বীকার করেন। এমন
সময় মেশিনগান উঁচিয়ে গুলি চালানো
হলো। ক্লারা
পেটাচি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঠিক
তখন মুসোলিনি তার জ্যাকেট খুলে
ফেলে তীব্র আর্তনাদ করে
বললেন, ‘আমাকে বুকে গুলি
করো’। অদিসিও
মুসোলিনির কথামতো তার বুকে
গুলি চালান। মুসোলিনি
মাটিতে পড়ে যান।
পড়ে গিয়েও তখনো মারা
যাননি। এ
সময় তিনি লম্বা লম্বা
শ্বাস নিচ্ছিলেন। অদিসিও
কাছে গেলেন এবং তার
বুকে আরেকটি গুলি করেন। মুসোলিনির
মুখ দেখে মনে হচ্ছিল
তার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। অদিসিও
তার গাড়িচালককে বললেন, ‘তার মুখের দিকে
তাকিয়ে দেখো, তার মুখে
ফুটে ওঠা এ ধরনের
আবেগ তাকে মানায় না।’
কর্নেল
ভ্যালেরি তাদের লাশের পাহারায়
একজন গার্ডকে রেখে ডুঙ্গো গ্রামে
ফিরে যান। সে
গ্রামেই আটকে রাখা হয়েছিল
বাকি ১৫ বন্দীকে।
মুসোলিনির সাথে থাকা তাদের
এরপর একই জায়গায় রাতের
দিকে পার্টিশান ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। ক্লারা
পেটাচির ভাই মার্সেলো পেটাচি
যখন লেক কমোতে ঝাঁপ
দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তখন
তাকে গুলি করে মারা
হয়। প্রথমে
পার্টিশানেরা মার্সেলো পেটাচিকে মনে করেছিল মুসোলিনির
পুত্র ভিট্টোরিও মুসোলিনি বলে।
মুসোলিনির
লাশ
২৯ এপ্রিল তাদের সবার
লাশ নিয়ে যাওয়া হয়
মিলানের ‘এসো গ্যাস’ স্টেশনে। সেখানে
৬টি লাশের পায়ে বেঁধে
মাথা নিচের দিকে ও
পা উপরের দিকে দিয়ে
গ্যাস স্টেশনে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই
ছয়টি লাশ ছিল মুসোলিনি,
ক্লারা পেটাচি, ফ্রান্সেসকো বারাকো, অ্যালেসান্দ্রো প্যাভোলিনি, ফার্নান্দো মেজাসোম্মা এবং পাওলো জারবিনোর। তাদের
ঝুলানো লাশের নিচে ছিল
আরো অনেকের লাশ।
বেশির ভাগ ছবিতে ঝুলানো
অবস্থায় ৬টি লাশ দেখা
গেলেও মাত্র কয়েকটি ছবিতে
৭টি লাশ ঝুলে থাকতে
দেখা যায়। বলা
হয়, আর্চিলি স্টারাচিকে গ্রেফতার করার পরপরই ঘটনাস্থলেই
হত্যা করে মুসোলিনির বাম
পাশে তার লাশ ঝুলিয়ে
দেয়া হয়। তার
লাশসহ ঝুলানো লাশের সংখ্যা
দাঁড়ায় ৭টি।
জনতা এসব লাশের পাশ
দিয়ে যাওয়ার সময় নিহতদের
প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছিল। কখনো
কখনো জনতা চরম বিশৃঙ্খল
হয়ে পড়ছিল। পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে মাঝে
মধ্যেই জলকামান ব্যবহার করতে হয়েছে।
এক সময় লাশগুলো কবর
দেয়ার জন্য সরিয়ে নেয়ার
আদেশ দেয়া হয়।
একটি বর্ণনা মতে, ঝুলানো
অবস্থা থেকে লাশগুলো নামিয়ে
টুকরো টুকরো করে কেটে
গর্তে ফেলে রাখা হয়। লোকজন
গর্তের পাশ দিয়ে যাওয়ার
সময় লাশগুলোর ওপর থুথু ছিটিয়ে
ঘৃণা প্রকাশ করে।
অ্যাডলফ
হিটলারের কাছে খবর পৌঁছে
স্ত্রীসহ মুসোলিনি ও তার সঙ্গীদের
হত্যা করে মিলানে তাদের
লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জনগণ
তাদের লাশকে নানাভাবে অপমান
করছে। তাদের
প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছে। তখন
হিটলার সিদ্ধান্ত নেন, তার বেলায়
এমনটি ঘটতে দেয়া হবে
না। মুসোলিনিকে
হত্যার মাত্র দুই দিন
পর স্ত্রীসহ হিটলার ১৯৪৫ সালের
৩০ এপ্রিল ফুয়েরার বাঙ্কারে
গানশুটে আত্মহত্যা করে মারা যান। মরার
পর হিটলারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী
তাদের লাশ পুড়িয়ে এর
ছাইভস্ম অজ্ঞাত স্থানে মাটিতে
পুঁতে রাখা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালের ২৯
এপ্রিলে যখন রেড আর্মি
আশপাশে যুদ্ধরত তখন সংক্ষিপ্ত আয়োজনে
হিটলার ইভাকে বিয়ে করেন। তখন
তার বয়স ২৯।
আর হিটলারের ৫৬। এর
৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে
সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে তিনিও আত্মহত্যা
করেন হিটলারের সাথে।
Comments