গণতন্ত্রায়ণ
কোনো দেশে গণতন্ত্র থাকা অথবা না-থাকা কোনো নিশ্চল বিষয় নয়। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে কীভাবে একটি দেশ অগণতান্ত্রিক অবস্থা (বিভিন্ন ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন, যেমন সামরিক আইন) থেকে গণতন্ত্রে উত্তরিত হয়। প্রশ্নগুলো সহজ ভাষায় বললে: কেন কিছু দেশ গণতান্ত্রিক এবং কিছু দেশ গণতান্ত্রিক নয়? কী করে একটি অগণতান্ত্রিক দেশ ‘অগণতন্ত্র’ থেকে ‘গণতন্ত্রে’ যেতে পারে? শেষ প্রশ্নের উত্তরের বিষয়টি গণতন্ত্রে উত্তরণ-প্রক্রিয়া বা গণতন্ত্রায়ণ বলে বর্ণনা করা হয়।
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে আধুনিকায়ন তত্ত্বের (Modernization Paradigm) আলোকে গণতন্ত্রায়ণ-সম্পর্কিত আলোচনায় বলা হয় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বেশি (লিপসেট, ১৯৫৯; এলমন্ড ও ভারবা, ১৯৬৩; মুর, ১৯৬৩)। যদিও লিপসেট তাঁর আলোচনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে (যেমন: নগরায়ণ, সম্পদ ও শিক্ষা) ‘আবশ্যক’ (Requisite) বলেছেন, ‘পূর্বশর্ত’ (Pre-requisite) বলেননি। পরবর্তী আলোচনায় এগুলো পূর্বশর্ত বলে বিবেচনা করা হতে থাকে।২ এমনকি ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত আমরা এই ধারায় ভূয়োদর্শনলব্ধ গবেষণা (Empirical Study) পরিচালনা হতে দেখি (যেমন: ভ্যানহানেন, ১৯৯৭)। বাস্তবে ১৯৭০-এর দশকে এসে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারা তৈরি হয় তখন এই যুক্তি কার্যত বাতিল হয়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে দক্ষিণপন্থী একনায়কত্বের অবসানের মধ্য দিয়ে যে ধারার শুরু, ১৯৮০-র দশকে লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এশিয়ায় তার প্রভাব রাখে এবং দশকের শেষ নাগাদ পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলো, এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নেও এর বাতাস লাগে। অব্যাহতভাবে দেশে দেশে একনায়কি শাসন, স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় ব্যবস্থা ইত্যাদির বদলে নির্বাচিত সরকারের উত্থানকে ১৯৯১ সালে স্যামুয়েল হান্টিংটন বর্ণনা করেন ‘গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ’ (Third Wave of Democracy) বলে (হান্টিংটন, ১৯৯১)। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সাফল্য এবং নেপালে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জন-আন্দোলন’কে এই তৃতীয় ঢেউয়ের প্রভাব বলেও ধারণা করা হয়ে থাকে। দেশে দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার এই ঢেউ এতটাই নাটকীয় ও অভূতপূর্ব ছিল, কেউ কেউ এরই আলোকে বিংশ শতাব্দীকে গণতন্ত্রের শতক বলে বর্ণনা করেন। এ নিয়ে আশাবাদ ও অতিশয়োক্তির ঘটনাও ঘটে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা বিজয়দৃপ্ত মনোভঙ্গিতে ঘোষণা করেন যে আমরা ইতিহাসের ‘অবসান’ প্রত্যক্ষ করছি (ফুকুইয়ামা, ১৯৮৯, ১৯৯২)।
১৯৭০-এর দশকে গণতন্ত্র অভিমুখে বিভিন্ন দেশের যাত্রা বিশ্লেষকদের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয় যে গণতন্ত্রায়ণ একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। তদুপরি এর প্রতিটি পর্যায়ের প্রতি গভীর মনোযোগ প্রদর্শন করা ও বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই ধারণাই গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে নতুন নতুন তত্ত্বের জন্ম দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়া বোঝার তাগিদকে জোরদার করে। এগুলোকে উত্তরণ তত্ত্ব (Transition Thesis) বলে চিহ্নিত করা হয়। কারও কারও মতে, গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়ার চারটি পর্যায় রয়েছে: কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার ক্ষয়, উত্তরণ, সংহতকরণ (Consolidation) এবং দৃঢ়করণ (Deepening)। কারও কারও মতে রয়েছে তিনটি স্তর: সুযোগ সৃষ্টি (Opening), ব্যূহভেদ (Breakthrough) এবং সংহতকরণ (Consolidation) (ক্যারোথারস, ২০০২)।
গণতন্ত্রায়ণের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে বলে যাঁরা মনে করেন, খানিকটা অবচেতনভাবেই তাঁরা একধরনের একরৈখিক পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ধারণাকে গ্রহণ করে নেন। অর্থাত্ গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে তা উত্তরণ পর্যায় হয়ে সংহতকরণ বা দৃঢ়করণ পর্যায়ে উপনীত হবে। ক্যারোথারস (২০০২: ৭) যথার্থই শনাক্ত করেন যে এই মতের প্রবক্তারা অস্বীকার করলেও এই ধারণার মধ্যে পরমকারণবাদের (Teleology) প্রভাব সুস্পষ্ট। গণতন্ত্রায়ণ, বিশেষত উত্তরণ পর্যায়ের দিককে যাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরও অনেক ধরনের সমালোচনা ইদানীং প্রকাশিত হচ্ছে। অন্যতম দুটি প্রধান সমালোচনা হলো, উত্তরণবিষয়ক আলোচনা সব সময়ই পরিবর্তনের সূচনাটি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা দিয়েছে (সেটা অর্থনৈতিক সংকট বা অভ্যন্তরীণ মতভিন্নতা, যে কারণেই ঘটুক না কেন)। তাঁরা কার্যত পরিবর্তনের চাপ যে নিচে থেকে অর্থাত্ তৃণমূল পর্যায় থেকে আসতে পারে, সেদিকটায় খুব গুরুত্ব দেননি। কিন্তু অনেক দেশেই তা লক্ষ করা গেছে। দ্বিতীয় সমালোচনা হলো, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও তার ভূমিকা মোটেই আলোচিত হয়নি। কোনো দেশের গণতন্ত্রায়ণে বাইরের পরিস্থিতি, শক্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আদৌ প্রভাব ফেলেছে কি না, তা অনালোচিতই থেকেছে। জেওফ্রি প্রিধাম একে গণতন্ত্রায়ণের ‘বিস্মৃত মাত্রা’ বলে বর্ণনা করেছেন (প্রিধাম, ২০০৫)।
গণতন্ত্রায়ণের, বিশেষত পর্যায়ক্রমিক কিন্তু একরৈখিক ধারার ধারণা কেবল যে গবেষকদেরই প্রভাবিত করেছে তা নয়, বিভিন্ন দেশের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রমকেও তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
এই পটভূমিকায়ই আরেকটি প্রশ্ন ক্রমেই জোরদার হয়ে ওঠে, তা হলো—গণতন্ত্র কী করে পরিমাপ করা যায়? প্রশ্নটি কেবল এই নয় যে কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ, প্রশ্নটি হলো, মর্মবস্তুর বিবেচনায় কোনটি গণতন্ত্র? প্রশ্ন ওঠে, ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘অগণতন্ত্র’ কি দ্বিমূল (Binary) ধারণা? (অর্থাত্ একটির অবস্থান অন্যটিকে নাকচ করে দেয়, একটি থাকলে অন্যটি উপস্থিত থাকতে পারে না।) নাকি গণতন্ত্র হচ্ছে স্তর বিন্যস্ত পরম্পরার (Continuum) একটি অবস্থান (অর্থাত্ গণতন্ত্রের ক্রমবিন্যাস করা সম্ভব)? অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্র-অগণতন্ত্রকে দ্বিবিভাজিত বলে মনে করেন এবং গণতন্ত্র পরিমাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্তরবিন্যাসের পক্ষে নন (সারটোরি, ১৯৮৭)। অন্যদিকে অনেকের ধারণা, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হওয়া দরকার চলমান ক্রমবিন্যাস-প্রক্রিয়া হিসেবে (বোলেন ও জ্যাকম্যান, ১৯৮৯)। এই বিতর্কের কোনো ধরনের সমাপ্তি না হলেও ক্রমবিন্যাসের ধারণার সমর্থকেরা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন গত কয়েক দশকে।
Comments